জাতীয় ঐকমত্য কমিশন সম্প্রতি জুলাই জাতীয় সনদের সম্পূর্ণ, সমন্বিত ও সংশোধিত খসড়া রাজনৈতিক দলের কাছে পাঠিয়েছে। এই খসড়ার উপর কোনো মতামত বা পরামর্শ দাখিলের শেষ সময় নির্ধারণ করা হয়েছে আগামী ২০ আগস্ট বিকেল ৪টার মধ্যে, যা কমিশনের কার্যালয়ে জমা দিতে হবে। গতকাল শনিবার এ তথ্য জানানো হয়।
খসড়া সনদটি বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, এতে একটি পটভূমি, সংস্কার কমিশন গঠন, জাতীয় ঐকমত্য কমিশন ও এর কার্যক্রমের সংক্ষিপ্ত পরিচিতি, ঐকমত্যে পৌঁছানোর বিষয়াবলী এবং জুলাই ২০২৫ সালের জাতীয় সনদ বাস্তবায়নের আট দফা অঙ্গীকারনা অন্তর্ভুক্ত রয়েছে।
পটভূমিতে বলা হয়েছে, ১৯৭১ সালে স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রে অনুরূপ মহান মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠার আকাঙ্ক্ষা তৈরি হয়েছিল, তবে তা দীর্ঘ ৫৩ বছরেও পূরণ হয়নি। কারণ, শাসন ব্যবস্থায় বারবার গণতান্ত্রিক পদ্ধতি ও সংস্কৃতি ভেঙে পড়েছে।
অতীতে আওয়ামি লীগ নেতৃত্বাধীন সরকারের কর্মকাণ্ডের উল্লেখ করে বলা হয়েছে, তারা রাজনৈতিক বিরোধী ও সমালোচকদের মানবাধিকার লঙ্ঘন, গুম, খুন, নিপীড়ন, মামলা, হামলা এবং বিভিন্ন অস্বস্তিকর পরিস্থিতি সৃষ্টি করে এক দমনপীড়নের রাজ্য বানিয়েছে।
খসড়ায় সংবিধান সংশোধনের জন্য সংসদের দুই কক্ষের দুই-তৃতীয়াংশ সদস্যের সমর্থন, গণভোটের মাধ্যমে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা পরিবর্তন, জরুরি অবস্থা ঘোষণায় প্রধানমন্ত্রী নয়, বরং মন্ত্রিসভার অনুমোদন থাকা, ও আইনগত বিষয়ে কয়েকটি আধুনিক ধারণার প্রস্তাব অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। এর মধ্যে আরও রয়েছে, প্রধানমন্ত্রী হিসেবে প্রার্থীর কোনও অন্য পদে থাকা জরুরি নয়, মেয়াদ সর্বোচ্চ ১০ বছর, ও একই ব্যক্তি একজন সময়ের জন্য প্রধানমন্ত্রী ও দলের প্রধান হতে পারবেন না—এমন বিধান সংবিধানে যুক্ত করা।
সংবাদে আরও বলা হয়েছে, সংসদ ভেঙে যাওয়ার পর ৯০ দিনের মধ্যে নির্বাচনের আয়োজন ও নির্বাচনকালীন সরকার পরিচালনার পরিকল্পনা রয়েছে। পাশাপাশি, নির্বাচন পদক্ষেপের জন্য প্রয়োজনীয় সংশোধনী, আইন ও বিধিনিষেধের বিষয়গুলোও স্পষ্ট করে উল্লেখ করা হয়েছে।
যে ৮৪ প্রস্তাবিত দফায় বিভিন্ন রাষ্ট্রব্যবস্থা, সংবিধান, বিচার ও আইন-শৃঙ্খলা, নির্বাচন ব্যবস্থা, মৌলিক অধিকার, রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রী নিয়োগ, তত্ত্বাবধায়ক সরকার, এবং অন্যান্য বিষয় বিষদভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে। সবগুলো দফার মধ্যে, ঐকমত্য প্রকাশ ও মতভেদ অনুযায়ী মতামতও স্পষ্টভাবে উল্লেখ করা হয়েছে।
সবশেষে, জুলাই ২০২৫ সালের ‘জাতীয় সনদ’ বাস্তবায়নের জন্য আট দফা অঙ্গীকারনামা উপস্থিত করা হয়েছে। এর মধ্যে অন্যতম হলো- গণতান্ত্রিক মূল্যবোধে জোর, জনগণের ইচ্ছাকে প্রধান্য দিয়ে এটি প্রণয়ন, এবং এতে প্রতিশ্রুতি রয়েছে, এই সনদের সব বিধান সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত করতে এবং কার্যকর করার জন্য প্রয়োজনীয় সংশোধনী ও পদক্ষেপ গ্রহণের।
অঙ্গীকারনামায় উঠে এসেছে, ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের মহান শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা ও তাঁদের আত্মার সত্ত্বেও সাংবিধানিক ও আইনি কাঠামো না থাকা সত্ত্বেও বিভিন্ন দফতর ও পদে অনিয়মের জন্য বহুকাল ধরেই এই কার্যক্রম অব্যাহত। এছাড়া, ১৯৯০ সালের গণঅভ্যুত্থানের পর প্রধান বিচারপতির পদত্যাগ ও অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি হিসেবে শপথ নেওয়ার ঘটনা যেমন আইনিভাবে প্রতিষ্ঠিত ছিল না; এটিও রাজনৈতিক অঙ্গীকারের ভিত্তিতে বৈধতা পায়।
প্রতিশ্রুতিগুলোর মধ্যে উল্লেখ করা হয়েছে যে, জনগণের অধিকার ও গণতন্ত্র পুনঃস্থাপনে দীর্ঘ আন্দোলন-সংগ্রামের ধারাবাহিকতায় ২০২৪ সালে গণঅভ্যুত্থানে অর্জিত প্রস্তাব ও বিভক্তির ভিত্তিতে নতুন রাজনৈতিক বন্দোবস্ত গঠন হবে। তাদের আশ্বাস, ‘জুলাই জাতীয় সনদ ২০২৫’ প্রত্যেকটি বিধান কার্যকর করা হবে, এবং এই সনদের বিধান বা সিদ্ধান্ত সংবিধান বা বিদ্যমান আইনের ওপর প্রাধান্য পাবে।
এছাড়া, এই সনদের আওতায় বাংলাদেশের রাষ্ট্র ব্যবস্থার সম্পূর্ণ সংস্কার, বিচারক, নির্বাচন ও প্রশাসন সংক্রান্ত প্রস্তাবগুলো বাস্তবায়ন করা হবে। সভার সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, গণতন্ত্র, মানবাধিকার ও আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার জন্য গণআন্দোলন ও অভূতপূর্ব গণ-অভ্যুত্থানের ঐতিহাসিক গুরুত্বকে সংবিধানিক স্বীকৃতি দেওয়া হবে।
এবং, ২০২৪ সালে গণঅভ্যুত্থানে শহীদদের মর্যাদা প্রদান, পরিবারকে সহায়তা, আহতদের চিকিৎসা ও পুনর্বাসনের দায়িত্ব সরকার নেবে। সবশেষে, যে কোনও প্রস্তাব বা সুপারিশ অবিলম্বে বাস্তবায়ন করার জন্য সরকারের ওপর জোড়ালো দায়িত্ব আরোপ করা হয়েছে।
জাতীয় ঐকমত্য কমিশন জানিয়েছে, এই খসড়ার আইনী বাধ্যবাধকতা ও বাস্তবায়নের উপায় নির্ণয়ে দেশে ও বিদেশে বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে আলোচনা করছে।