ভারতের লাদাখে রাজ্য মর্যাদা ও সংবিধানের ষষ্ঠ তালিকায় অন্তর্ভুক্তির দাবি নিয়ে চলমান আন্দোলন তাৎক্ষণিকভাবে সহিংসরূপে পরিণত হয়েছে। গত বুধবার লেহ শহরে ব্যাপক বিক্ষোভে কমপক্ষে চারজন নিহত ও ৮০ জনের বেশি আহত হয়েছেন। পরিস্থিতির অবনতি হওয়ায় লেহ শহরে কারফিউ জারি করেছে ভারতীয় নিরাপত্তা বাহিনী।
হিমালয়ের সাড়ে ১১ হাজার ফুট উচ্চতার এই ছোট শহর লেহয়ে এখন তীব্র শীতের মধ্যেও বিক্ষোভের আগুন জ্বলছে। এই আন্দোলনে তরুণদের মধ্যে ব্যাপক উৎসাহ দেখা যায়, যারা লাদাখের আলাদা রাজ্য ও বিশেষ সংবিধানিক মর্যাদা পাওয়ার দাবি তুলেছেন। এরই অংশ হিসেবে কেন্দ্রীয় ক্ষমতাসীন দল বিজেপির স্থানীয় কার্যালয়ে অগ্নিসংযোগের ঘটনাও ঘটেছে।
২০১৯ সালে অনুচ্ছেদ ৩৭০ বাতিলের পর থেকে লাদাখের রাজ্য মর্যাদার দাবিটি আরও জোরালো হয়ে উঠে। ১০ সেপ্টেম্বর থেকে পরিবেশকর্মী সোনম ওয়াংচুকসহ ১৫ জন নানা দাবি নিয়ে অনশন চালাচ্ছিলেন, যার মধ্যে ছিল রাজ্য ঘোষণা, চাকরির কোটা ও লেহ ও কার্গিলে একটি স্থানীয় লোকসভা আসনের দাবি।
আন্দোলনের শুরুর দিকে তারা অনশনে ছিলেন, কিন্তু শারীরিক অবনতি ঘটায় আন্দোলনের এক পর্যায়ে যুব সংস্থা লাদাখ অ্যাপেক্স বোর্ডের (এলএব), এর ব্যানারে বিক্ষোভ আরও জোরদার হয়। বুধবার সকালে হাজার হাজার বিক্ষোভকারী এনডিএস মেমোরিয়াল থেকে লেহ শহর প্রদক্ষিণের জন্য মিছিল বের করলে পরিস্থিতির চরম অবনতি হয়। মিছিলের সময় বিজেপি সদরদপ্তর ও হিল কাউন্সিলের কার্যালয়ে দাঙ্গাকাণ্ডের মতো পরিস্থিতি সৃষ্টি হলে পুলিশ কাঁদানে গ্যাস ছোড়ে। জনতা সহিংস হয়ে ওঠে, এতে দফায় দফায় সংঘর্ষ হয় এবং অন্তত চারজন নিহত ও ৮০ জনের বেশি আহত হন, যাদের মধ্যে প্রায় ৪০ জন পুলিশ সদস্য রয়েছেন।
বিক্ষোভের মধ্যে কয়েকজন আহত হয়েছেন, যা পরিস্থিতির আরও কঠিন রূপ নিতে পারে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন সংশ্লিষ্টরা। ঘটনায় সমাপ্তি টেনে সোনম ওয়াংচুক প্রেমিকাকে নেযেছিলেন পরিস্থিতি স্বাভাবিক করার জন্য। তিনি বলেন, ‘আমি সকল যুবকদের শান্তিপূর্ণ পথে ফিরে আসার আহ্বান জানাচ্ছি। আমরা লাদাখ বা দেশের অস্থিতিশীলতা চাই না।’
অন্যদিকে, বিজেপি এই বিক্ষোভের জন্য কংগ্রেসকে দায়ী করতে চাইছে। বিজেপির আইটি সেল প্রধান অমিত মালব্য এক্সে (প্রাক্তন টুইটার) ছবি পোস্ট করে দাবি করেছেন, লেহ শহরের এক কংগ্রেস কাউন্সিলর বিক্ষোভকারীদের উসকানি দিতে দেখা গেছে।
পার্টি নেতা সাম্বিত পাত্রা দিল্লিতে এক সংবাদ সম্মেলনে অভিযোগ করেন, এই আন্দোলন স্বচক্ষে দেখানো হচ্ছে যে কংগ্রেসের ষড়যন্ত্র, যেখানে অস্ত্র নিয়ে কাউন্সিলররা বিজেপি কার্যালয়ের দিকে মিছিল করছে। তিনি আরও বলেন, ‘এটা রাহুল গান্ধী ও দেশের বিশিষ্ট ব্যক্তিরা মিলেই দেশকে অস্থিতিশীল করার চক্রান্ত।’
অন্যদিকে, সোনম ওয়াংচুক এসব অভিযোগকে অযৌক্তিক বলে উড়িয়ে দিয়ে বলেন, ‘লাদাখের কংগ্রেসের এত প্রভাব নেই যে তারা হাজার হাজার তরুণকে রাস্তায় নামাতে পারে। মূলত, শান্তিপূর্ণ আন্দোলনের ফল না হওয়ার কারণে তরুণরা হতাশ হয়ে সহিংসতায় জড়িয়ে পড়েছেন।’ তিনি আরও জানান, শেষ দুই দিনে বিশেষ করে বুধবারের বিশৃঙ্খলার কারণে পরিস্থিতি আরও গুরুতর হয়ে উঠেছে।
বিক্ষোভকারীদের মধ্যে দুজন বয়স্ক নাগরিকের আহত হওয়ার ঘটনাও ঘটেছে, যা দীর্ঘদিনের দাবি ও কেন্দ্রের প্রতিশ্রুতির তারিখ পিছিয়ে দেওয়ার সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে প্রতিক্রিয়া হিসেবে দেখা হয়।
লাদাখের এই দাবিগুলো ২০১৯ সালে অনুচ্ছেদ ৩৭০ বাতিলের পর থেকে তীব্র হয়ে উঠেছে, তবে ভারতীয় সরকার এখন এই দাবিকে কংগ্রেসের ষড়যন্ত্র হিসেবে ব্যাখ্যা করে দোষ চাপানোর চেষ্টা করছে।
লাদাখ ভারতের কৌশলগত একটি এলাকা, যা চীনাদের সঙ্গে ১৬০০ কিলোমিটার সীমান্ত শেয়ার করে। ২০২০ সালে ভারতের ও চীনের সেনাদের মধ্যে সংঘর্ষের মূল কেন্দ্র ছিল এই অঞ্চল। বর্তমানে, এই সীমান্তবর্তী এলাকায় চলমান অস্থিরতা ভারতের জন্য নতুন এক চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
বিশ্লেষকরা বলছেন, ২০১৯ সালে কেন্দ্রীয় সরকারের নেওয়া সিদ্ধান্তের ফলাফল এখন ঘরে ঘরে প্রকাশিত হচ্ছে। আগে কাশ্মীরের জন্য যেমন পর্যবেক্ষণ ছিল, এখন লাদাখও ভারতের পরিকল্পনায় চাপে পড়ে গেছে, যা সরকারের জন্য একটি বাড়তি মাথা ব্যথা হয়ে উঠেছে।